MAJHIPARA I BAGHAICHORI I RANGAMATI I 2025

Bohemian Faisal

MAJHIPARA I BAGHAICHORI I RANGAMATI I KHARACHARI I Bohemian Faisal I 2024 

যেখানে আমিই নাকি প্রথম পর্যটক।

মাজিপাড়া, বাঘাইছড়ি,রাঙামাটি।

পর্ব-১

চারদিকে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন গুলোর চলাফেরা ,পাহাড়ের এক পাশে ভারতের মিজোরাম রাজ্য অন্যপাশে বাংলাদেশের বাঘাইছড়ি এবং বরকল উপজেলার সীমানা।আজকের ভ্রমণ গল্পটা একটু অন্য ধাজের,নতুন গড়ে উঠে জুম ক্ষেতে রাত্রী যাপন তাও আবার রাত এগোরাটার দিকে নিজেরা খোজ করে বের করা। দীর্ঘ কয়েকযুগ পর গড়ে উঠা এসব জুম ক্ষেত উদ্ভূত একটা সৌন্দর্য্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

এবার মূল গল্পে আসা যাক, বাঘাইছড়ি পার্বত্য চটগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের গেস্ট হাউজে আমার অবস্থান।এই গেস্ট হাউজ এবং বাঘাইছড়ির কিছু লোকজন আমায় খুব আপন করে নিয়েছে এটা আসলে আমার ভাগ্য।বাঘাইছড়ি নিয়ে এর আগেও আমি অনেক গুলো পর্ব লিখেছি , এবার ভ্রমনের প্রথম দিনের গল্প স্কিপ করে দ্বিতীয় দিন দিয়ে শুরু করছি। আমার মানষিক অবস্থার করুণ দশা, বাঘাইছড়ি যাওয়ার আগে ইমন দাদাকে বলছিলাম আমার আর বাচতে মন চায় না।ইমন দাদা আমারে বললো আপনি বাঘাইছড়ি আসেন আপনাকে নিয়ে নতুন একটা জায়গায় যাবো যেখানে এখন পর্যন্ত কোন পর্যটক যায়নি।মনের অশান্তি সাথে এই অফার শুনে আমি বের হয়ে পরলাম।প্রথমেই বলছিলাম এই বাঘাইছড়ির মানুষজন আমায় আপন করে নিয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হলো এই ইমন দাস।

আমরা এমন একটা জায়গায় যাবো যেখান কোন দোকানপাট নাই এমনকি জুম ঘরে যে থাকবো তারও কোন নিশ্চয়তা ছিলো না।তবে আমরা হাড়িপাতিল ছাড়াই রান্না করে খাবো সেটার একটা পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম গত রাতেই।বাজার থেকে আগেরদিন রাতে মুরগি এবং টুকটাক জিনিস কিনে তা ইমন দাদার বাসায় রাখলাম। সকালে সেগুলো নিয়ে ইমন দাদা আমার কাছে আসলো। এবার আমাদের যাত্রা শুরু, আপাতত মোট দুটো মোটরসাইকেলে চারজন যাচ্ছি । সদ্য নির্মাণাধীন উচুনিচু পাহাড়ি পিচঢালা রাস্তা,কোথো কাচা কোথাও আবার ইট খোয়ার মিশ্রণ আবার কোথাও  মাটি কেটে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।তীব্র রোদের সাথে পাহাড়ের অপরুপ সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আমরা সামনে এগোচ্ছি।পুরো রাস্তাজুড়ে ভারি যানবাহনের বহর,সেনাবিহীন্ কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের এসব গাড়ি।এবারের ভ্রমণে আমি অনেক কিছু হাইড করে রাখবো কারণ এই পাহাড়ের পরিস্থিত এখনো সাধারণ মানুষের অনুকুলে না।আমরা কিছুদূর আগানোর পর ইমন দাদার এক বন্ধুর বাসায় কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। আমাদের এখান থেকে মূলত কোন আর বাঙালির বসবাস নাই।আমরা যত ভিতরে যাবো পাহাড়িদের বসবাস ততই কমে যাবে এমনই ধারণা দিয়ে রাখছিলো ইমন দাদা।

যাত্রা আবার শুরু ,আমরা আস্তেধীরে উচু নিচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে সামনে এগোচ্ছি।সামনে যত এগোচ্ছি রাস্তার অবস্থা ততই শোচনীয় হচ্ছে। চলমান এই সীমান্ত রাস্তার এই পাশটায় এখনো ইট পাথরের দেখা পায়নি শুধু ভ্যাকু দিয়ে রাস্তা তৈরি করে রেখেছে।আমরা পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়রণ্যে ঢুকলাম।শীতের পরের এই রুক্ষ পাহাড় কেবল মাত্র সবুজ হওয়া শুরু করেছে।মাঝেমধ্যে দু একটা মোটরসাইকেলের দেখা পাচ্ছি আর কিছুই নাই।জুম ঘরের যা দেখা পাচ্ছি তা পাহাড়ের অনেক দূরে।আমরা মূলত যাবো মাঝিপাড়া ক্যাম্পের কাছাকাছি,এই মাঝিপাড়া ক্যাম্প এক সময় ছিলো পাহাড়ের সবচেয়ে দূর্গম একটি ক্যাম্প কিন্তু এই সীমান্ত রাস্তা হওয়ার কারণে সবকিছু এখন হাতের নাগালে।

আমাদের সামনে এখন যে রাস্তাটা সেটি আরো ভয়ংকর এবং সুন্দন,বিশাল বাশ বাগানের মধ্যে দিয়ে তৈরিকরা  হয়েছে এই রাস্তা।যদিও সেই বাশ বাগানের সৌন্দর্য্য এখন চোখে পরে না ।তীব্র রোদের তাপে সবকিছু রুক্ষ হয়ে আছে।এই যে সুন্দর পাহাড় এখানে লেগে আছে অনেক রক্তের দাগ।একে হলো গহীন জঙ্গল তার উপর জনবসতিহীন,যে কারনে এসব জায়গায় গড়ে উঠেছিলো পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন গুলোর ক্যাম্প সহ অনেক গুলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।বাঘাইছড়ি,লংগদু ,বরকল এসব জায়গা গুলো ছিলো শান্তি বাহিনীর অভয়রন্য।শান্তি বাহিনী চুক্তিতে আসলে সশস্ত্র পাহাড়ি সংগঠন গুলো ভেঙ্গে অনেক গুলো সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে।পাহাড়ে এখন অশান্তি নিজেদের মধ্যে। আমরা যে জায়গাটায় যাচ্ছি সেটিও একটি রণক্ষেত্র।আমরা যে জায়গাটায় যাচ্ছি সেটি পাহাড়ে ইউপিডিএফ গনতান্ত্রিকের দখলে একটি জায়গা।

মাঝিপাড়া ক্যাম্পের কাছাকাছি যাওয়ার আগে উচু একটি পাহাড় থেকে সোজা নিচে নামতে হয়,আমরা যখন নিচের দিকে নামছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো স্বর্গের কাছাকাছি আছি।আমার সাথে যারা ছিলো তাদের একজন ছিলো চাকমা বন্ধু ,ও ছিলো আমাদের সাহস।আমরা এখন নামতে নামতে একটা ঝিরিতে এসে উপস্থিত হলাম।এই ঝিরি হলো আমাদের বিশ্রামের জায়গা যেখানে আমরা রান্না করবো তারপর গোসল করে রাত্রিযাপনের জন্য আবার পাহাড়ের উপরে উঠবো।রান্না কিভাবে করবো তার ধারণা আমার তখন ছিলো না। আমি ভাবছি আমাদের সাথে রাতে থাকার জন্য আরো কয়েকজন আসবে বিকালে তারা হয়তো হাড়িপাতিল নিয়ে আসবে। ঝিরির পাশে সবাই বসে পরলাম,ইমন দাদা সহ বাকিরা বাশ কাটতে গেলো তখনই আমার মাথায় আসলো আয়হায় এতো বাম্বুতে সবকিছু রান্না হবে। যদিও আমরা দা নিয়ে এসেছিলাম যে কারণে আমাদের সবকিছু সহজ হচ্ছিলো। ঝিরি দিয়ে হালকা পানি বইয়ে ,সেই পানিতে সাতার কাটতেছে চিংড়ি মাছ এবং কাকড়া।রান্নার জন্য সবকিছু প্রস্তুত এবার একটা বাশের মধ্যে চাল অন্য দুটোর মাঝে মুরগির মাংস বসিয়ে দিলাম।অদ্ভূত সুন্দর একটা সময় পার করতেছি যা বলে প্রকাশ করা যাবে না।কিছুক্ষন পরপর শুকনা ডালপালা আনতেছি আর আগুন ধরাচ্ছি।

একবার ভাবেন আপনার কাছে হাড়িপাতিল নাই কিন্তু আপনাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে হবে তখন কি করবেন ,আমরা সেই সুন্দর সময়টা পার করতেছি।আশেপাশে  কোন মানুষের আনাগোনা নেই নেই কোন ঝই ঝামেলা। পাখিদের কলতানে মুখোরিত চারদিক তারমধ্যে বসে আমরা রান্না করতেছি।এই যে সুখটা এটা কোটি টাকা দিয়ে কেনা যাবে ?পাহাড়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটাই আলাদা একটা ফিল দেয়। চার কেজি মাংস সাথে বিন্নি চালের ভাত সবকিছু মিলিয়ে র একটা পরিবেশ।একধাপ খাওয়া শেষে আমি আর ইমন দা গেলাম গোসলের উদ্দেশ্যে।গহীন অরণ্যের ঝিরি যেখানে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে সে একটা জায়গায় গোসলের জন্য নেমে পরলাম।হিম শীতল ঠান্ডা পানিতে মন পুরিয়ে ডুবালাম।ঝিঝি পোকার ডাক গুলো সাইকেডেলিক পাখির মত লাগছিলো। দ্বিতীয় বার আরেকবার খাইলাম এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।আমরা যেখানে বসে ছিলাম সেখান থেকে প্রায় দু হাজার ফুট উচুতে আমাদের উঠতে হবে।আর যেখানটায়া আমরা যাবো সেখান থেকে মেজোরাম এবং বাংলাদেশ উভয়কে সুন্দর ভাবে দেখা যায়।আসলে মাঝিপাড়া ক্যাম্পের যে জায়গাটায় আমরা এখন আছি সেটার কোন নাম নেই অথবা আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমি নতুন কিছু পেয়েছি।অবশেষে মূল চূড়ায় উঠলাম, উঠার সময় অনেক গুলো জুম ঘর দেখতে পেলাম। সদ্য তৈরিকৃত এই জুম ঘর গুলো এখানের জুম ক্ষেত গুলোতে কেন্দ্র করে নির্মাণকরা হয়েছে। এই জায়গা গুলোতে এই প্রথম জুম চাষ হচ্ছে। এবার ভাবুন এই জায়গা আসলে কত দূর্গম ছিলো।সূর্য এখন ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে যে কারণে চারদিকের দুরত্বে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।একটা অস্থায়ী তাবু পেলাম সেখানে,আসলে এই তাবুটা কে বা কারা বানাইছিলো তা আমরা কেউ জানিনে।হ্যামকটা বের করে দুটো গাছের সাথে টানিয়ে দিলাম।এরপর চারদিকে নজর রাখছিলাম আমরা আসলে এমন একটা জায়গায় আছি যেখান দেখে দুটো দেশের সৌন্দর্য্য উপভোগকরতেছি। মিজোরামের বান্দিছড়ার কাছাকাছি আমাদের অবস্থান। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো আমরা যে জায়গায় আছি আপাতত এখানেই শেষ হয়েছে সীমান্ত রাস্তার কাজ।এরপর কই দিয়ে রাস্তা নিবে তার কোন চিহ্ন নাই। আমরা একদম শেষ সীমান্তে আছি।পাহাড় নিয়ে সবারই একটা আলাদা টান থাকে কিন্তু আমার টান একটুবেশিই যা মনে হলো। যারা হিমালয় যায় তাদের ব্যাপারটা আরো আলাদা ,জয়ের নেশায় তারা মত্ত।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো আমাদের চূড়ায়, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মিজোরামের আলোকিত বিভিন্ন ছোটছোট শহর।এদিকে আমাদের এই সাইটটা একদম অন্ধকার।সুন্দর বাতাস সাথে জুনিক পোকা সবকিছু মিলিয়ে আলাদা একটা পরিবেশ। আকাশে উদিত হলো লক্ষ কোটি তারা ,আমার আজকের দিনটা ১০০/১০০ কাটছে রাতটাও মেবি ১০০/১০০ কাটবে। তারার সাথে রাত কাটাবো আজ কি এক সুখ।একটা পর্যায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজ রাত এই তাবুর নিচেই কাটাবো তাই আশপাশ থেকে বিভিন্ন গাছপালা কেটে এটাকে থাকার মত বানাচ্ছিলাম।কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছিলো বাতাসের তীব্রতা তত বাড়তেছিলো তাতে যা বুঝলাম যে পরিমান শীত লাগবে তাতে এখানে আর টেকা যাবে না।

এরমধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটলো আমরা যে জায়গাটায় ছিলাম সেখান থেকে সাজেকের লাইটিং গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।ইমন দার মতে সাজেক এবং এই মাঝিপাড়া ক্যাম্প একই পাহাড়ে অবস্থিত।এটা আসলে কোন রেঞ্জে পরছে সেটা জানতে পারিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *