ISHTIAK AHMED
দেবতাখুম I BANDARBAN I ISHTIAK AHMED I BANGLADESH I 2024
খুমের রাজ্যে একদিনঃ দেবতাখুম ভ্রমণ ।
বান্দরবান জেলার নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের প্রচলিত রূপ কথায় আছে অত্র এলাকায় একসময় বাস করত অসংখ্য বানর । আর এই বানরগুলো শহরের প্রবেশ মুখে ছড়ার পাড়ে পাহাড়ে প্রতিনিয়ত লবণ খেতে আসত। এক সময় অনবরত বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বৃ্দ্ধি পাওয়ায় বানরের দল ছড়া পাড় হয়ে পাহাড়ে যেতে না পারায় একে অপরকে ধরে ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পাড় হয়। বানরের ছড়া পারাপারের এই দৃশ্য দেখতে পায় এই জনপদের মানুষ। এই সময় থেকে এই জায়গাটির পরিচিতি লাভ করে “ম্যাঅকছি ছড়া ” হিসাবে । অর্থ্যাৎ মার্মা ভাষায় ম্যাঅক অর্থ বানর আর ছিঃ অর্থ বাঁধ । কালের প্রবাহে বাংলা ভাষাভাষির সাধারণ উচ্চারণে এই এলাকার নাম রুপ লাভ করে বান্দরবান হিসাবে । বর্তমানে সরকারি দলিল পত্রে বান্দরবান হিসাবে এই জেলার নাম স্থায়ী রুপ লাভ করেছে। তবে মার্মা ভাষায় বান্দরবানের নাম “রদ ক্যওচি ম্রো”।
বৃটিশ শাসন আমলে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন সময়ে বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অধীন ছিলো। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়-চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল, এবং বোমাং সার্কেল। বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে বান্দরবান জেলার আরেক আদি নাম বোমাং থং।
বান্দরবান জেলা ১৯৫১ সালে মহকুমা হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। এটি রাংগামাটি জেলার প্রশাসনিক ইউনিট ছিলো। পরর্বতীতে ১৯৮১ সালের ১৮ই এপ্রিল, তৎকালিন লামা মহকুমার ভৌগলিক ও প্রশাসনিক সীমানাসহ সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এই মুহুর্তে আমরা মূলত যাচ্ছি, বান্দরবান এর ৭ উপজেলার একটি রোয়াংছড়ি তে প্রায় ৪৪৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই রোয়াংছড়িতেই সেই বিখ্যাত দেবতাখুম অবস্থিত।
রোয়াংছড়ি যাবার পথেই পড়বে রামজাদি মন্দির। এই মন্দিরটি বান্দরবন জেলার কালাঘাটাস্থ হদা বাবুর ঘোনা অবস্থিত। মাত্র ৪ কিলোমিটার মতো দুরত্তে ২টি বৃহদাকায় মন্দির এবং ২টিই শহর থেকে একটু বাইরে জনশূন্য এলাকায়। এ মন্দিরে উঠতে হলে প্রায় সাড়ে ৩শ ফুট সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে।বান্দরবান শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। হাঁটার অভ্যাস থাকলে শহর থেকে হেঁটেই চলে যেতে পারেন এখানে।
যাইহোক পাহাড়ি আঁকা বাকা উঁচু নিচু পথ ধরে এবার আমাদের ছুটে চলার পালা। রোয়াংছড়ির পানে। পথি মধ্যেই মেঘ থেকে থেকে এসে ছুয়ে যায় যে পথে।
দেবতাখুম বান্দরবানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত স্থান পর্যটকদের কাছে। দেবতাখুম ভ্রমণে শুরু থেকে রোমাঞ্চ হাতছানি দিয়ে যায়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথ দিয়ে চান্দের গাড়ির যাত্রায় শান্ত প্রকৃতি ভ্রমনকারীদের অন্তরে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। বান্দরবান শহর থেকে প্রথমেই রোয়াংছড়ি পৌঁছাতে হয়। সেখানে গাইড নিয়ে নাম-ঠিকানা জমা করতে হয় রোয়াংছড়ি থানায়। সকলের জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে ভ্রমণ করা এখানে আবশ্যক। দেবতাখুম ভ্রমণে গাইড ছাড়া এক পা-ও এগোতে দেবে না স্থানীয় প্রশাসন।
রোয়াংছড়ি থানায় নাম-ঠিকানা জমা দেওয়ার পর কচ্ছপতলী বাজারে লিরাগাঁও সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আবারও জমা করতে হয় দর্শনার্থীদের নাম-ঠিকানা।
রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী মাত্র ১০ কিলোমিটার এর পথ। পথিমধ্যে যতদূর চোখ যায়, রাস্তার দু’ধারে ধরা পড়ে ঢেউ খেলানো অসংখ্য পাহাড়। দিগন্তবিস্তৃত উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়ে ঘিরে থাকা অঞ্চল তার বিশালতা প্রমাণ করে। পাহাড়ের চূড়ায় গুচ্ছাকারে কিছু জমে থাকা থাকা মেঘ ধরা পড়ে চোখে। নীলগিরির পথের মতো স্বচ্ছ মেঘ এখানে খালি চোখে ধরা না দিলেও সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় সামান্য মেঘের স্তুপ ভ্রমণে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। চান্দের গাড়িতে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করলে ৩৬০ ডিগ্রি প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়। পাহাড়ি লোকেদের পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা কলাগাছ, আখ, জুম চাষের ক্ষেত দেখে।
সেনাবাহিনীর কাছে চেক ইন করার পর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দুপুরের খাবার আপনি কচ্ছপতলী বাজারে খাবেন, নাকি দেবতাখুমের পথে পাহাড়িদের বাড়িতে। অনেকেই স্থানীয়দের হাতে তৈরী রান্না খেতে ভালোবাসেন। পাহাড়ি জুমের তৈরী চাল, লাল মুরগির সমন্বয়ে সুস্বাদু খাবারের আয়োজন থাকে সেখানে। এক্ষেত্রে গাইডের সাথে আলোচনা করে রাখবেন আগে আগেই। গাইডই সব ব্যবস্থা করে দেবে। গাইডের নির্দেশনানুযায়ী ভ্রমণ করলে দেবতাখুম সফর অনেকখানি সাবলীল হয়ে যায় পর্যটকদের। বলে রাখা ভালো, দুপুর ১২টার মধ্যেই রোয়াংছড়ি থানা ও কচ্ছপতলী বাজারের লিরাগাঁও সেনাবাহিনী ক্যাম্পে চেক ইন করতে হবে।
যাইহোক, কচ্ছপতলী বাজার থেকে দেবতাখুম পৌঁছানোর রাস্তা দুটি। আপনি যদি রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চান, তাহলে পাহাড়ি পথে পা বাড়াবেন আর যদি শারীরিক পরিশ্রমকে কাছে না টেনে স্বস্তি চান, তাহলে ঝিরিপথে যাওয়াই মঙ্গল। আমরা মূলত যাচ্ছি পাহাড়ি পথ মারিয়েন, যদিও বা ফিরবো ঝিরিপথে।
পাহাড়ি পথের যাত্রায় একদম প্রথম কদম থেকেই আপনাকে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। দীর্ঘদিনের জং ধরে থাকা শরীর আপনার মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্লান্তি ধরিয়ে দেবে। সুবিশাল উঁচু পাহাড়ে প্রতি পদে পদে আপনার শারীরিক সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষা হবে। একে একে তিনটি পাহাড় মাড়াতে হবে। পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা গাছ ও সবুজ দৃশ্য আপনার মানসিক মনোবল বৃদ্ধি করবে সামনে এগোতে। গাছের ফাঁক দিয়ে বেড়ে ওঠা নীল আকাশের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য মন ভরাতে যথেষ্ট । দুর্গম, নিরিবিলি ও ভূতুড়ে পথে পাহাড়ি লাল মাটির ঘ্রাণে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়।
পরপর তিনটি পাহাড় পেরিয়ে আপনার উপলব্ধি হবে, পর্যটক ও স্থানীয় মারমা সম্প্রদায়ের কৃষিকাজ করা ব্যক্তিদের পদচারণায় পাহাড়ের বুকে মাটি অনেকখানি সিঁড়িতে রূপ নিয়েছে। এই সিঁড়িরূপী পাহাড়ি মাটি সামনের পথেও বন্ধু হয়ে দেখা দেবে। একধাপ-দু’ধাপ করে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এগোবেন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। কয়েক প্রজাতির পাখি ও গাছের সংমিশ্রণে দেবতাখুমের যাত্রাপথ সমৃদ্ধ। আমাদের গ্রুপে মূলত দুই জন গাইড এক সর্বদাই সামনে এগিয়ে আরেকজন পেছনে। শক্তিতে তারা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
পঞ্চাশ মিনিটের অধিক সময় পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আমরা দেখা পেয়েছিলাম প্রথম ঝিরিপথের। ঝিরির পানির স্রোত শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট করলেও মানসিক তৃপ্তি উপহার দেবে তার হিমশীতল বৈশিষ্ট্যে। ঝিরিপথের বাকি অংশ কেবলই উচ্ছ্বাসের গল্প। কারণ অল্প একটু এগোলেই শীলবাধা পাড়া।
এ পাড়ায় গুটিকয়েক ঘর দেখা যায়। সেখানে মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস। পাড়ার মারমাদের জীবিকা নির্ভর করে পাহাড়ে চাষাবাদ এর উপর। দুয়েকটি দোকান দেখা গেলেও পণ্যের ঘাটতি রয়েছে। নিজেরাই মালিক, আবার নিজেরাই খদ্দের। পাড়ার ঘরগুলো যেহেতু মাটি থেকে কয়েক ‘ফুট উপরে অবস্থিত, তাই নিজেদের তৈরি কাঠের সিঁড়ি কাজে লাগায় তারা। এই পাড়ার পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে বেয়ে চলা ঝিরিপথ, চারপাশ ঘিরে থাকা পাহাড়, পাথুরে পথ ও চমৎকার নীল আকাশ আপনার মনকে ভাল করে দেবে।
এই শীলবান্ধা পাড়াতেই আপনার ব্যাগ বস্তা রেখে বেড়িয়ে পড়তে পারেন। এখান থেকেই দেবতাখুমের মূল আকর্ষণ শুরু। সিড়ি বেয়ে নেমে, ঝিরির সামনের ছড়া পার হয়ে মূলত টিকিট কাউন্টার যেখান থেকে জনপ্রতি হিসেবে প্যাকেজ নিতে হয়। ১৫০টাকার জন প্রতি প্যাকেজে পাবেন লাইফ জ্যাকেট, নৌকা ও ভেলার।
দেবতাখুম এর ট্রেইল যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ংকর। বর্ষায় গেলে ট্রেইলের ঝিরি/পাহাড়ের রূপে যেমন আপনার চোখ আটকাবে তেমনি পিচ্ছিল পাথুরে পথে পা ফসকে বড় ধরনের বিপদে পড়ার আশঙ্কাও থাকে পদে পদে। কোন কোলাহল নেই, নেটওয়ার্কের বাহিরে। চারিপাশে নিস্তব্ধ সুনসান নিরাবতা, যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশ।
বাকি পথটুকুতে ভ্রমনকারীরকে দুবার নৌকায় পার করে দেয়। নৌকা সর্বদা প্রস্তুত সেখানে। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট পরিধান বাধ্যতামূলক। কারন নিরাপত্তা সবার আগে।
দেবতাখুমের ভেতরে যাওয়া উপায় দুইটি। প্রথমটি নিজের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে দিয়ে নৌকায় চেপে বসা। সেক্ষেত্রে এক নৌকায়ন ৮-১০ জন উঠতে পাবেন। অন্য টি হলো ভেতরে যাবার জন্য বাকি দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেয়া। সহজ কথায় আগে থেকে তৈরি ভেলায় বসে পথ পাড়ি দিতে হবে। কাঁচা বাশের শক্তপোক্ত ভেলা রূপকথার উড়ে যাওয়া চাদরের মতো লাগে। দেবতাখুমের পানি প্রচণ্ড সবুজ ও ঠাণ্ড। শীতের মৌসুমেও প্রশান্তির বার্তা দিয়ে যায়। আবহমান বাংলার মাঝিদের ব্যাপারে কবিদের লুকিয়ে থাকা বাসনা শুধুমাত্র প্রকাশ পেয়েছে। কখনোই ধরা পড়েনি এই পেশায় নিয়োজিতদের শারীরিক পরিশ্রমের বিষয়টি। খুমের ভেতরে বৈঠা ঠেলে ভেলা নিয়ে যতই ভেতরে প্রবেশ করেছি, ততই শ্বাস-প্রশ্বাস ভারি হচ্ছিল আমাদের। ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছিল ভেলা চালাতে। নিজেকে যোদ্ধা মনে হচ্ছিল। আমাদের টিমের প্রায় সবাই আগে চলে গেলেও আমি আর টিপু ভাই পড়ে রইলাম ভেলার অপেক্ষায়।
খুমের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০০ ফুট। পথিমধ্যে অসংখ্য পাথর গতিপথ পাল্টে দেয়। মূলত ভেলা ও পাথরের সংঘর্ষে এই ঘটনাটি ঘটে। বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে নিজের ভেলাকে উদ্ধার করে নিতে হয়। ভেলা নিয়ে যতই ভেতরে প্রবেশ করবেন, ততই নিজেকে ভীষণ সুখী মানুষ মনে হবে। শারীরিক কসরত বেশি হলেও খুমের অকল্পনীয় সৌন্দর্যের রূপ সকল ক্লান্তি মুছে দেবে।
সুনসান নীরবতায় ঘেরা দেবতাখুম। পৃথিবীর সমস্ত নীরবতা যেন এখানে এসে জমা হয়েছে। প্রশান্তি নিয়ে ভেলায় শুয়ে তৃপ্তির ঘুম অসম্ভব কিছুই নয়। খুমের দুদিকে বেড়ে ওঠা দানবাকৃতির পাহাড় যেন খুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে কয়েকগুণ। খুমের অপার্থিব মায়াবী দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে পর্যটকরা সামনে এগোতে থাকে। সামনে দেখা মেলে সরু পথের, তখন মোড় ঘুরিয়ে আবারও সোজা আকৃতিতে আনতে হয় ভেলা। আরও খানিকটা পথ সামনে এগোলেই খুমের শেষ প্রান্তের দেখা মিলবে। ৬০০ ফুটের এই পথ পাড়ি দিতে সময়ের প্রয়োজন হবে আনুমানিক ১ ঘণ্টা। যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের সময় তুলনামূলক বেশি লাগবে।
খুমের শেষ প্রান্তে পাথুরে পরিবেশে তীব্র স্রোতের দেখা মেলে। সামুদ্রিক স্রোতের খণ্ডচিত্র বলা চলে।
আমাদের বাড়বকুণ্ড ট্রেইল এর ভ্লগটি যারা দেখে ছিলেন তারা জানেন কি বিপদেই পরেছিলাম আমরা। একি টাইপ বিপদে পরে ছিলাম এই যাত্রা তেও। এ পথেই প্রায় ভেলা চালানো বন্ধ হয়ে যায় বর্ষাকালে। স্রোতের বিপরীতে ভেলা চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। উপরে বৃষ্টি হওয়ার বানের পানির স্রোতে আজও একি পরিস্থিতি সৃষ্টি। প্রবল পানির স্রোত ভেলা নিয়ে তীরে ভেরা অসম্ভব। ৬ বার উল্টো পথে ভেসে গেলেও প্রবল মনো বল ও ইচ্ছা শক্তি নিয়ে ৭ বার এর চেস্টায় কাছাকাছি চলে আসি আমরা। কিন্তু ভেলা অপর পাশে নেয়া যে প্রায় অসম্ভব। এবার পালা আমাদের অপর পাশে যাওয়ার। তাও আবার এই প্রবল স্রোতে ভেসে না গিয়েই।
ভেলা থেকে নেমে পাথরের বুকে পা রাখার পরক্ষণেই মনে হবে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ চলছে। রোদের ঝিলিক পাহাড় বেয়ে খুমের পানিতে পড়লে, প্রকৃতি হলুদাভ বর্ণে ফুটে ওঠে। এ এক অসাধারণ দৃশ্য।
খুম থেকে ফিরে এবার পালা শীলবান্ধা রে যাওয়ার। শীলবান্ধা পাড়া থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পায়ে হাটার পথ শীলবান্ধা ঝর্ণা। প্রায় শত ফুট উপর থেকে যে ঝর্ণার হিম শীতল পানি অনবরত পড়তে থাকে। বর্ষায় এই ঝর্নার থাকে ভরা যৌবন। তুলনা মূলত সহজ আসার পথ সেই সাথে কম বিপদজনক এই শীলবান্ধা ঝর্ণা। দেবতাখুম থেকে ফিরে শীলবান্ধা ঝর্ণার পানিতে করা গোসল। মুহুর্তেই আপনার শরীর ও মনের সকল ক্লান্তি দুর করে দেবে।
পাহাড়ি পথ মারিয়ে শীলবান্ধা পাড়ায় আসলেও ফিরতি পথ ধরলাম আমরা ঝিরি পথে। স্রোতের বিপরীতে ঝিরিপথ দিয়ে সাধারণত বর্ষাকালে হেঁটে পার হওয়া যায় না। তখন পাহাড়ি পথ একমাত্র আশ্রয় দেবতাখুম যাওয়ার। শীতকালে গেলে আসা-যাওয়ার জন্য দুটো পথেই পা মাড়ানো যায়। একবেলা পাহাড় হলে অন্যবেলা ঝিরিপথ। এই যাত্রায় আমরা ফিরছি ঝিরিপথ ধরেই। ঝিরিপথে নাম-পরিচয়হীন তিন থেকে চারটি ঝর্ণা রয়েছে। প্রতিটি ঝর্ণা শীতকালে মৃত থাকে, বর্ষায় জেগে ওঠে।
অসম্ভব রকমের এডভেঞ্চার ভরপুর সেই সাথে মনকে ভয়ার্ত করে দেয়ার জন্যে পারফেক্ট দেবতাখুম ট্রিপ। ট্রেকিং, এডভেঞ্চার, রিস্ক, ভেলায় কায়াকিং সবকিছুর একটি কম্বো প্যাকেজ এই দেবতাখুম। একেবারে নেটওয়ার্ক এর বাইরে, ভিন্ন এক পরিবেশ। আশেপাশের সব সুনসান। শব্দ হিসেবে থাকবে উপর থেকে পানির ফোটা পরার শব্দ, নিজেদের ভেলার আওয়াজ এবং আপনার কথারই প্রতিধ্বনি!
যাবার আগে পুরো ট্রিপটাই দেখতে পারেন-
খুমের রাজ্যে একদিনঃ দেবতাখুম
যাবার উপায়ঃ
- ফিরতে ফিরতে আসুন জানি দেবতাখুম যাওয়ার উপায় সম্পর্কে। প্রথমেই আপনাকে দেশের যেকোন প্রান্ত হতে আসতে হবে বান্দরবান শহরে। বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি বাজার যাওয়ার উপায় বাস/সিএনজি। বাসের ক্ষেত্রে, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে রোয়াংছড়ি’র বাস ছাড়ে। বান্দরবান শহর থেকে রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ডে যেতে সিএনজি/অটো পাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া ১০/১৫টাকা নিবে।
- বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি বাস জনপ্রতি ৬০টাকা। সময় লাগবে ১ঘন্টার মতন।
- আর সিএনজি’র ক্ষেত্রে বান্দরবান থেকে সরাসরি একদম রোয়াংছড়ি বাজারের সিএনজি পাবেন৷ সিএনজি রিজার্ভ প্রায় ৫০০-৬০০ টাকার মতন নিবে।
- দেবতাখুমে যেতে হলে আপনাকে গাইড নিতে হবে আর গাইড রোয়াংছড়ি বাজার থেকেই নিতে হবে।
- রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী যেতে হবে সিএনজি’তে। সময় লাগবে ৩০/৩৫মিনিটের মতন।
- কচ্ছপতলীতে এন্ট্রি করার পর তারপর হাঁটা পথ এবং পাহাড় ট্রেকিং করে শীলবাধা পাড়া৷ কচ্ছপতলী বাজারের পর আর দোকান পাবেন না তাই পানি, খাবার কিনতে চাইলে এখান থেকেই কিনতে হবে। কচ্ছপতলী থেকে শীলবাধা পাড়ায় যেতে সমগ লাগবে ৪৫- ৬০ মিনিটের মতন।
- শীলবাধা পাড়া থেকে তারপর ১৫ – ২০ মিনিটের মতন পথ হাঁটলেই দেবতাখুম। তারপর ভেলা নিয়ে খুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া।
- আর হ্যা, এই দেবতাখুম ট্রিপে কিছু কথা অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
- সাধারণ জুতায় ট্র্যাকিং করা অস্বস্তিকর এমনকি বিপদজনকও বটে। তাই, একজোড়া ট্র্যাকিং-সু নিবেন।
- যাত্রাপথের জন্য হালকা খাবার-দাবার সঙ্গে রাখবেন, কারণ ঘুরে আসতে ৩/৪ ঘন্টা বেশি লাগতে পারে।
- সুপেয় পানি নিতে ভুল করবেন না।
- ফোন অপারেটরদের তেমন কোন নেটওয়ার্ক পাবেন না তাই সেই ধরনের মানসিক প্রস্তুতি রাখবেন। যতটুকু নেটওয়ার্ক পাবেন তাও রবি ও টেলিটক এর।
- জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের ফটোকপি নিয়ে যাবেন, কারণ আর্মি ক্যাম্পে অনুমতি নিতে হবে।
- এই ট্রিপ কোনভাবেই রিল্যাক্স কোন ট্রিপ নয়। এটি একটি এক্সট্রিম এডভেঞ্চারাস ট্রিপ। যারা যত কম ট্র্যাকিং ট্রিপ করেছেন, তার জন্য এই ট্রিপ ততটাই কষ্টদায়ক আর রোমাঞ্চকর হবে। এই ট্রিপে সর্বমোট ৩-৪ ঘন্টা হাটা লাগবে সেই সাথে নিজের ব্যাগ, পানির বোতল নিজেদেরকেই বহণ করতে হবে। তাই শারীরিক ও মানুষিক ভাবে যারা বিশ্বাস রাখেন আপনি পারবেন শুধু মাত্র তারাই যাবেন।
দেশবাসী অতঃপর আরেকটি দিনের সমাপ্তি সেই সাথে সমাপ্তি আরেকটি অসাধারণ ট্রিপের। দিনের আলো নিভে আসছে এবার যে ঘরে ফেরার পালা। ফিরতে মন চাইবে না, তবু আমাদের ফিরতে হয়। বরাবরি আমি একটা কথাই বলি। ট্যুরে জান, ট্রেকিং এ জান। যেখানে মন চায় জান। যেভাবে মন চায় জান। কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়। এমন কিছুই করবেন না। প্লিজ লাগে। আর হ্যা সময় পেলে সকলেই বেড়িয়ে পড়ুন। ঘুরতে থাকুন জানতে থাকুন জানাতে থাকুন। কিপ রোমিং।